দুই শহরের গল্প : মেডিকায় সফল হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট মিলিয়ে দিল বাংলা আর ত্রিপুরাকে



ওয়েব ডেস্ক; কলকাতা, ৭ জানুয়ারি : অন্যান্য রাজ্যে নিজেদের ক্লিনিক্যাল কেয়ারের পরিষেবা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে মেডিকা গ্রুপ অফ হসপিটাল, পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় বেসরকারি হসপিটাল চেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল ত্রিপুরার বাসিন্দা রণজিৎ রায়ের হার্ট ট্রান্সপ্লান্টে। রণজিৎ রায় সেপাহিজলার বর্যালা এলাকার বাসিন্দা, যিনি দোকানদারের কাজের সাথে যুক্ত। উনি ভুগছিলেন ডায়েলেটেড কার্দিও মায়োপ্যাথি সমস্যা থেকে। এটি এক ধরনের হার্টের মাংসপেশির সমস্যা যার ফলে হার্টের চেম্বার সরু এবং লম্বাটে হয়ে যায়, রক্ত সঞ্চালন সমস্যা হয়ে যায়। পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছিল ওনার হার্ট ফেল করার পরিস্থিতি ছিল এবং বেশিদিন বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। হার্ট সার্জারি বিভাগের বিভিন্ন অভিজ্ঞ ডাক্তার যুক্ত ছিলেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন ডা. কুণাল সরকার, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট কার্ডিয়াক সার্জেন মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল, কলকাতা, ডা. সৌমজিত ঘোষ, কনসালটেন্ট কার্ডিয়াক সার্জেন, ডা. দীপাঞ্জন চ্যাটার্জি, ইকমো ফিজিশিয়ান এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট। এছাড়া মেদিকার কেয়ার টিম যোগদান করে এই অস্ত্রোপচারে। রণজিৎ রায় ত্রিপুরা থেকে প্রথম মানুষ যার সফল হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট হল কলকাতা থেকে।

রণজিৎ রায় ভুগছিলেন ডায়েলেটেড কার্দিও মায়োপ্যাথি থেকে, যার ফলে দৈনন্দিন কাজকর্ম অসম্ভব হয়ে উঠছিল। দিনকে দিন পরিস্থিতি কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে উঠছিল ওনার জন্য। ওনাকে বেশ কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। তবে তার মধ্যে কিছু কিছু ওনার জন্য বড্ড বেশি দামী ছিল। উনি বাড়ির একমাত্র রোজগেরে এবং বাড়িতে উনি ছাড়া রয়েছেন ছেলে, স্ত্রী এবং অসুস্থ না। তিন মাস আগে, ডা. কুণাল সরকার ওনাকে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করার কথা বলেন এবং এও জানান যে কাউকে হার্ট দান করতে হবে। অনেক অপেক্ষা করার পর গত ৩০শে ডিসেম্বর বর্ধমান নিবাসী ৫১ বছর বয়সী থিয়েটার ব্যাক্তিত্ব হিরন্ময় ঘোষালের হার্টের ব্যাপারে কথা হয়। ২৮শে ডিসেম্বর ওনাকে মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে আনা হয় আর ৩০শে ডিসেম্বর তাকে ব্রেন ডেড ঘোষণা করা হয়। 

গত ৩০ শে ডিসেম্বর রণজিৎ রায়কে বলা হয় দেরি না করে ত্রিপুরা থেকে আসতে। গ্রহীতা এবং যিনি দান করবেন, উভয়েই সেই সময় হসপিটালে ছিলেন এবং দুটো অস্ত্রোপচার একসাথে করতে হতো। মেডিকা হসপিটালে এই মিরাকেলের মত হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল আর অত্যাধুনিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর জন্য। সমগ্র মেডিকা এবং রণজিৎ রায়ের পরিবার প্রয়াত হিরন্ময় ঘোষালের পরিবারের প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে।

ডা. সৌমজিত ঘোষ জানান," পুরো বিষয়টি আমাদের কাছে খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল, বিশেষ করে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কারণ আমাদের কাছে স্রেফ চার ঘন্টা সময় ছিল দান করা হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার জন্য। ভবিষ্যতের জন্য আমরা এখন থেকে অনেক আত্মবিশ্বাসী অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা অ্যাডভান্সড হার্ট সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে।"

ডা. দীপাঞ্জন চ্যাটার্জি বলেন," মিস্টার রায়ের সেরে ওঠা সত্যি একটা মিরাকেল এবং বর্তমানে তিনি সম্পূর্ণ ভাবে বিপদ থেকে মুক্ত। ওনার হার্ট কাজ করছে এবং শরীরের অন্যান্য সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে। ইমুইনো সপ্রেসেন্তের ব্যবহার স্টেবল করার পর অ্যান্টিবায়োটিক কমানো হয়েছে। এই মুহূর্তে রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রয়েছে। দানকারী পরিবারের মহানুভবতার ফলে নতুন জীবন পেয়েছেন মিস্টার রায়। আমরা একদিকে যেমন মিস্টার ঘোষালের পরিবারের জন্য দুঃখিত আবার তাদের কুর্নিশ জানাই শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঁচটি অঙ্গ দান করার উদাহরণে। ওনার পরিবারের মত বাকি মানুষেরাও যেন এগিয়ে আসেন এবং ডাক্তারদের সাহায্য করেন, আরো প্রাণ বাঁচানোর ক্ষেত্রে।

ডা. কুণাল সরকার, যিনি এই অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দেন, বলেন," আমরা সমগ্র মেডিকা থেকে ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ মিস্টার ঘোষাল এবং তার পরিবারকে হার্ট দান করার জন্য এবং মিস্টার রায়ের প্রাণ বাঁচানোর জন্য। আমরা বেশ কয়েক মাস ধরে অপেক্ষা করেছি এবং তার সাথে সাথে জানতে থেকেছি যে মিস্টার রায়ের শারীরিক দুর্বলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট ভীষণ দরকারি ছিল এবং যেই মুহূর্তে দানকারী পরিবারের থেকে সম্মতি পাই, সেই মুহূর্তে আমরা অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। রোগী সেরে উঠছেন এবং আজকে ওনাকে হসপিটাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ডাক্তার হিসেবে আমরা মানুষের মধ্যে অঙ্গদানের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে চাই যাতে আরও বেশি মানুষকে প্রাণে বাঁচানো যায় এবং আরো বেশি পরিবার যেন অঙ্গদানের ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ হন।"

উদয়ন লাহিড়ী, সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ডিরেক্টর, মেডিকা গ্রুপ অফ হসপিটাল, বলেন,"ভারতের মোট জনসংখ্যার ১% এর ক্ষেত্রে হার্ট ফেলের ঘটনা দেখা গিয়েছে। যদি আগে ধরা পড়ে, তাহলে অনেক প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। প্রান্তিক মানুষদের অনেকের কাছে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সময়ের অভাবে এই অস্ত্রোপচার সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই জীবন বাঁচানোর তাগিদে আমরা প্রান্তিক এলাকায় সম্পূর্ণ নিখরচায় স্বাস্থ্য শিবির আয়োজন করে থাকি এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে থাকি। আমরা এখানে মানুষের আর্থিক অবস্থা, লিঙ্গ, নাগরিকত্ব নির্বিশেষে সবাইকে সেবা করার লক্ষ্য নিয়ে এগোই। আমরা ধন্যবাদ দিতে চাই যে আরেকটা জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষকে বোঝাই যে কোন রকম দোটানায় না থেকে মৃত্যুর পর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দানের জন্য, যাতে আমরা আরো বেশি মানুষকে বাঁচাতে পারি।"

"আমরা ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ হিরন্ময় ঘোষাল এবং তার পরিবারের কাছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দানের জন্য এবং সমাজের কাছে একটি ইতিবাচক উদাহরণ তুলে ধরার জন্য। এই মহৎ উদ্যোগ ৫টি আলাদা আলাদা মানুষ এবং তাদের পরিবারকে নতুন করে বাঁচার শক্তি দিয়েছে," বলেন অয়নাভ দেবগুপ্ত, সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ডিরেক্টর মেডিকা হসপিটালস প্রাইভেট লিমিটেড।

Post a Comment

0 Comments