ওয়েব ডেস্ক; ৪ এপ্রিল:
নিগ্রহের শিকার বয়স্করাও - অবসানের উপায় এবং আমাদের সামাজিক কর্তব্য বললেন ডাঃ চন্দ্রিমা নস্কর (সিনিয়র রেসিডেন্ট, পিজিআইএমইআর, চণ্ডীগড়) এবং
ডাঃ দেবাঞ্জন ব্যানার্জী (কনসালট্যান্ট জেরিয়াট্রিক সাইকিয়াট্রিস্ট, অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল, কলকাতা)।
কোনও এক অশীতিপর বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা একলা পড়ে আছেন, শরীরে অনশনের ছাপ স্পষ্ট, আর সেই দাগ ছাপিয়ে ফুটে রয়েছে কালশিটে মাখা একটা করুণ চাহনি। ভাবছেন নিশ্চই, ”এসব তো সিনেমার পরদায় দেখা যায়- আমার আপনার পাড়ায় আবার এসব হয় নাকি,”? লীলা মজুমদারের ভাষায় বলা যায়- “হয়, হয়, জান্তি পারোনা!”
ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেসানের (WHO) সংজ্ঞা অনুযায়ী বয়স্ক মানুষদের নির্যাতন অথবা নিগ্রহের (Elder abuse) অর্থ হল কোনও এক বয়স্ক অথবা বয়স্কার ভরসাযোগ্য কোনও আত্মীয় পরিজনের তাঁদের প্রতি এমন কোনও এক বা একাধিক ব্যবহার যাতে তাঁদের শারীরিক কিংবা মানসিক হানি হতে পারে। যদিও এই বিষয়টি নিয়ে তেমন কথাবার্তা হয়না, কিন্তু নিরীক্ষার হিসেবে এই ধরণের ঘটনার সংখ্যা নিতান্তই অল্প নয়। সারা পৃথিবীতে প্রায় প্রত্যেক ছ’জনের মধ্যে একজন বয়স্ক নির্যাতনের শিকার হন! আমাদের মধ্যে এক বিশ্বাস কাজ করে যে এই সব ঘটনাগুলি প্রত্যেক পরিবারের ব্যাক্তিগত সীমার মধ্যে পড়ে, কাজেই সেই বেড়াজাল টপকে এ নিয়ে আলোচনা করা হয়ত অনুচিত। এদিকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে নির্যাতনকারী কিন্তু পরিবারেরই কেউ , কিংবা পরিবারের নিয়োগ করা পরিচারক বা পরিচারিকা।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এই বৃদ্ধ- বৃদ্ধারা নিজেরাও কোনও রকম সাহায্য নিতে পিছপা হয়ে যান কারণ তাঁরা চাননা যে এমন লজ্জাজনক ঘটনা সমাজে জানাজানি হোক। কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা সাহায্য কীভাবে পাওয়া যায় তা সম্বন্ধেই অবগত থাকেননা। কখনও সবকিছু বুঝে শুনেও আইনি জটিলতায় ফেঁসে নাজেহাল হওয়ার ভীতি থেকে তাঁরা এ বিষয়ে কাউকে বলেন না। দুঃখজনক বিষয় হল নির্যাতিত বয়স্কদের মধ্যে বহুসংখ্যক বৃদ্ধ- বৃদ্ধা সাহায্য চাওয়ার অবস্থাতেই থাকেন না।
নিগ্রহ মানে যে কেবল মারধোর করা, তা কিন্তু নয়। যেকোনো রকম মানসিক, শারীরিক কিংবা আর্থিকভাবে কষ্ট দেওয়া কিংবা তাঁদের প্রয়োজনগুলিকে অবহেলা করাও নির্যাতনের আওতায় পড়ে। শারীরিক নির্যাতন বলতে যেমন আমরা বুঝি বয়স্ক মা-বাবার গায়ে হাত তোলা, ধাক্কাধাক্কি ইত্যাদি, সেইরকমই তাঁদের পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে-পরতে না দেওয়া, রোগ- বিরোগে চিকিৎসা না করানোও কিন্তু একেক প্রকার শারীরিক নির্যাতন। বয়স্ক- বয়স্কাদের যৌন নির্যাতন অকল্পনীয় শুনতে লাগলেও বাস্তবে তার নজিরের অভাব নেই। মানসিক ভাবে তাঁদেরকে বকুনি-হুমকি দেওয়া, ভুল বোঝানো, অকারণে দোষারোপ করা, ভয় দেখিয়ে তাঁদের থেকে কিছু আদায় করার চেষ্টা করা, একলা ফেলে রাখা, কথাবার্তায় কোনও কান না দেওয়া অথবা অবহেলা করা ইত্যাদিও বৃদ্ধ বয়সে নিদারুণ কষ্ট দিতে পারে। বিনা অনুমতিতে তাঁদের মানসিক বা শারীরিক অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে ব্যাঙ্ক আ্যকাউন্ট বা এটিএম কার্ডের অনুচিত ব্যবহার করা আর্থিক নির্যাতনের পর্যায় পড়ে।
প্রশ্ন হলো গিয়ে এমন পরিস্থিতির কথা আমরা জানব কীভাবে? বেশীরভাগ সময়েই আমরা এ বিষয়ে কাউকে কোনও প্রশ্ন করিনা, এবং বয়স্ক মানুষেরাও সামাজিক দ্বিধায় নিজের থেকে এমন কথা কাউকে বলেন না। সেজন্য, আমাদের প্রথম প্রয়োজন চোখ-কান খোলা রাখা। শারীরিক নিগ্রহের লক্ষণ শরীরে সহজেই দেখা যায়- কিন্তু অন্যান্য নির্যাতনগুলি অতো সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু খেয়াল করলে কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। ছেঁড়া/ অপরিষ্কার শাড়ি- জামা, ভাঙ্গা চশমা, হঠাৎ করে মনমরা বা চিন্তিত থাকা, হঠাৎ স্মৃতিভ্রংশ শুরু হওয়া, ডাক্তারের কাছে কিংবা অন্য কোনও সামাজিক পরিস্থিতিতে বয়স্ক মানুষটিকে কোন শুভানুধ্যায়ীর কাছে একলা না ছাড়তে চাওয়া ইত্যাদি প্রচ্ছন্নভাবে নিগ্রহের সম্ভাবনা জানান দিতে পারে।
এই অব্দি পড়ে আপনি ভাবতেই পারেন যে, “বেশ, নিগ্রহের লক্ষণ না হয় বুঝলাম, কিন্তু বুঝে আমি কীই বা করতে পারি?” পুলিশ কাছারিকে আমরা সবাই ভয় পাই, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া আমাদের মনে আশা নয়, বিভীষিকা জাগায়। কিন্তু দরকার পড়লে এই ধরণের অবস্থায় আইনি সাহায্য নেওয়া জরুরী। “পিতামাতা এবং প্রবীণ নাগরিকদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং কল্যাণ আইন, ২০০৭”(Maintenance and Welfare of Parents and Senior Citizens Act, 2007) এক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইনগুলির মধ্যে অন্যতম জরুরী আইন, যেটির মূল বার্তা হল বয়স্ক মা-বাবার খেয়াল রাখবার কর্তব্য তাঁদের সন্তানদের এটি আইনত স্পষ্ট করা, এবং আইনিভাবে বয়স্কদের নিগ্রহ কিংবা অবহেলা থেকে সুরক্ষিত রাখা। এটির সম্বন্ধে আমাদের সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
আসলে, বয়স্কদের নির্যাতন একটি সামাজিক সমস্যা। কাজেই এর সমাধানের জন্য সমাজকেই তৈরি হতে হবে। স্কুলে কলেজে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া, টিভি-রেডিও- সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বয়স্কদের নির্যাতন নিয়ে অনেক বেশী কথাবার্তা শুরু করা, ষাটোর্ধ মানুষদের মধ্যে জনসংযোগ তৈরি করা, তাঁদের মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে সক্ষম করা, যাতে তাঁরা নিজের পরিবার-প্রতিবেশির বাইরেও কারুর থেকে নির্দ্বিধায় সাহায্য চাইতে পারেন। শুধু তাই না- বয়স্ক মানুষদের প্রতি স্বভাবগতভাবে একটা দয়া বা করুণার মানসিকতা না রাখা, প্রত্যেক বৃদ্ধ- বৃদ্ধাকে দুর্বল- অক্ষম- অশীতিপর না ভাবা- এগুলিও আমাদের নিজেদের মধ্যে বদল আনার প্রথম কিছু পদক্ষেপ। বার্ধক্যকে এক কথায় নেতিবাচক বলে না মেনে নিয়ে, বরং প্রবীণ নাগরিকদের সাহায্যের কথা মাথায় রেখে আগামীদিনের সমাজ গঠন করলে বরং সেটা সকলের পক্ষেই সুবিধেজনক হবে। আমাদের অনেকের মধ্যেই এমন একটা মানসিকতা কাজ করে যে বয়স বেড়ে যাওয়া মানেই একটি ক্রমশ ক্ষয়মান বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কাজেই বয়স্কদের ভালভাবে বাঁচার অধিকারও তাঁদের বয়স বাড়ার সাথে সাথেই কমতে থাকে। এই প্রবণতাটিকে ইংরেজিতে ageism বলে। Ageism বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি দুর্ব্যবহার, নিগ্রহ, অবহেলা ইত্যাদির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। সেইজন্য, এই সামাজিকভাবে এই মানসিকতা পালটানো অত্যন্ত দরকারি।
ডিমেনশিয়া/বয়সজনিত স্মৃতিভ্রংশের জন্য যত্নশীল প্রশিক্ষণ, নিগ্রহ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন, দুর্ব্যবহার বা নিগ্রহের বিষয়ে তথ্য জানান দেওয়ার বাধ্যতামূলক এবং সহজ রিপোর্টিং সিস্টেম, এবং বৃদ্ধাবাসগুলিতে যত্নের মান উন্নত করা —সবই নিগ্রহ প্রতিরোধের জন্য কার্যকর কৌশল। আইনগুলিকে তাঁদের প্রতি আরও সংবেদনশীল করতে বয়স্ক ব্যক্তিদের এবং তাঁদের কাছের মানুষজনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা জরুরী। সরকারী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি যেমন বয়স্ক ব্যক্তিদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে, তেমনই এই মানুষগুলির পরিবার- পরিজনদের সাথে তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলি সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করলে নিগ্রহ-নিরজাতন কমানোর নানান উপায় বেরোতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এমন ও হয় যে পরিবার পরিজন নিজের অজান্তেই এমন কিছু ব্যবহার করে ফেলেন তাঁদের আশেপাশে থাকা বয়স্ক মানুষদের সাথে যে তা নির্যাতনের পর্যায় পড়ে। সেসব ক্ষেত্রে তাঁদের সাথে বিষদে আলোচনা করা এবং তাঁদের এ বিষয়ে অবগত করাটাও নির্যাতন কমানোর অন্যতম কার্যকরী উপায়। বিশেষত বৃদ্ধাশ্রমের কর্মীদের, সব স্তরের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরী। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্ক থাকার শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন যাতে তাঁরা সহজে নিগ্রহের ছোট ছোট লক্ষ্যণগুলি ধরে ফেলতে পারেন।
বার্ধক্য অনিবার্য, কিন্তু বার্ধক্যের বছরগুলি যাতে কষ্টকর না হয়ে ওঠে সে দায়িত্ত্ব আমার- আপনার – সব্বার। 2021-2030 এই দশকে UN-এর লক্ষ্য হল ‘বয়সবাদের’ বিরুদ্ধে লড়াই করা, এবং একটি বয়স্ক-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। আমরা যদি সবাই মিলে এই লক্ষ্যে সামিল হই তবে আমরা অবশ্যই অদূর ভবিষ্যতে এমন একটি নিগ্রহহীন জগৎ তৈরি করতে সক্ষম হব, যেখানে আমরা সকলেই বয়সকালে আনন্দের সাথে থাকতে পারব।
0 Comments