ওয়েব ডেস্ক; কলকাতা, ৪ই জানুয়ারি : মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল, পূর্ব ভারতে মাইলফলক তৈরি করল সফলভাবে প্রথম ক্রনিক টোটাল অক্লুশান (সিটিও) ইম্পেলার এর সাহায্যে, যা একজন ৬৬ বছরের ঢাকুরিয়া নিবাসী পুরুষের ক্ষেত্রে হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া একটি কার্ডিয়াক টিমের দ্বারা সম্পন্ন হয় যেখানে নেতৃত্ব দেন ডঃ দিলীপ কুমার, ডিরেক্টর - কার্ডিয়াক ক্যাথ ল্যাব সিনিয়র কনসালটেন্ট ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এবং ইলেকট্রো ফিজিওলজিস্ট, চিফ অ্যাকাডেমিক কোঅর্ডিনেটর মেডিকা ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্স (এমআইসিএস)। ওনাদের এই পুরো প্রক্রিয়ায় সাহায্য করেন ডঃ দীপাঞ্জন চ্যাটার্জি, ডিরেক্টর ইকমো এবং থোরাসিক অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট প্রোগ্রাম, ফিজিশিয়ান, বিভাগীয় প্রধান কার্ডিও পালমোনারি কেয়ার স্পেশালিস্ট, মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল। এই সাফল্যের সাথে, ডঃ দিলীপ কুমার সফলভাবে করেন বেলুন মিট্রাল ভালভুলোপ্লাস্টি শিলিগুড়ির ৩৩ বছর বয়সী আরতি সিংহের উপর। আরতি সিংহের যমজ বাচ্চার প্রেগনেন্সির ৩২ তম সপ্তাহ চলছিল যখন এই অস্ত্রোপচার হয়েছিল মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে।
কার্ডিয়াক কেয়ার এর দিক থেকে ইম্পেলা ডিভাইস একটি বৈপ্লবিক সমাধান, বিশেষ করে সাধারণ প্রসিডিওরের দিক থেকে যখন সুবিধা বা লাভ হয় না দুর্বল হার্টের জন্য। এই ইম্পেলা ডিভাইস খুব কাজের হয় ক্রিটিক্যাল পরিস্হিতিতে, যেমন হার্ট অ্যাটাক, যেখানে চটজলদি কার্ডিয়াক শক সামাল দেওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা কম এবং হার্টের কাজের ক্ষতি হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। এই রিস্ক বা বিপদ কমানোর জন্য, ইমপ্ল্যান্ট বসানো হয় অস্থায়ী ভাবে যেখানে দরকারি হার্টের কাজ নিয়ন্ত্রিত হয়, যাতে হাতে ৪-৬ ঘন্টা থাকে ইন্টারভেনশনের জন্য। যেখানে অনেকটা আর্টারি ব্লকেজ থাকে, সেখানে পুরো ইন্টারভেনশন প্রক্রিয়া দেরি হতে পারে, অতিরিক্ত সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। ইম্পেলা ডিভাইস বিশ্বের সবচেয়ে ছোট হার্ট পাম্পিং মেশিন, এই পরিস্থিতিতে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিগুলোয় এই ডিভাইস হার্টের উপর চাপ কমাতে সাহায্য করে, যা শুধু কার্ডিওলজিস্টদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। অন্যান্য কার্ডিয়াক অস্ত্রোপচারের থেকে ইম্পেলা আলাদা, কারণ এটির কোন বিকল্প নেই। ইম্পেলা শুধুমাত্র যে চিকিৎসার পরিধি বাড়িয়েছে তা নয়, এর সাথে রোগীদের জীবনের পরিধি বা আয়ু বাড়িয়েছে যাদের জটিল হার্টের সমস্যা রয়েছে। এই ডিভাইস বসানো হয় সেই সব রোগীদের যাদের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করার প্রয়োজন রয়েছে। এই ডিভাইস সময় দেয় সেই সব মানুষদের, যাদের ট্রান্সপ্লান্ট করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই ডিভাইস অস্থায়ী ভাবে শরীরে বসানো হয়। ইম্পেলা বাইরে থেকে কন্ট্রোল করতে সাহায্য করে কনসোলের মাধ্যমে আইসিইউতে। এই কনসোলের সাহায্যে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ সুবিধা হয়, রক্ত সঞ্চালন সহজ হয় এবং অন্যান্য জরুরি মাত্রা মাপার ক্ষেত্রেও সুবিধা হয়। রিকভারির ক্ষেত্রে সময়সীমা আলাদা হয়ে থাকে এক রোগী থেকে আরেক রোগী। আঞ্জিওপ্লাস্টির ক্ষেত্রে ৩০ মিনিটের মত সময় লাগে, যা প্রমাণ করে এই ডিভাইসের কার্যকারীতা।
আরেকটি কেসে দেখা গিয়েছে একজন ৩৩ জন মহিলার ক্ষেত্রে, যার দুটো যমজ সন্তানের জন্ম হয় আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে। উনি গর্ভবতী অবস্থায় ৩২ সপ্তাহ চলাকালীন এই ক্রিটিক্যাল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। মিট্রাল ভালভ স্টেনসিস হওয়ার কারণে শ্বাস কষ্টের সমস্যার মুখোমুখি হয়, কারণ এই সমস্যার জন্য বাম দিকের হার্ট চেম্বারে ভালভের মধ্যে ফারাক কমে গিয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য হার্টের প্রধান পাম্পিং চেম্বারে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা তৈরি হয়, যার ফলে হার্ট ফেল করার সম্ভাবনা বাড়ে এবং মা এবং বাচ্চাদের জীবন সংশয়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। প্রথম দিকে বেলুন মিট্রাল ভালভুলোপ্লাস্টি অন্য একটি শিলিগুড়ির হসপিটালে চেষ্টা করা হলেও অসফল হয়। তারপর তাকে মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে ট্রান্সফার করা হয়। এই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বিশেষ করে মা এবং বাচ্চাদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে ডঃ দিলীপ কুমার মিনিমালি ইনভেসিভ প্রসিডিওর অর্থাৎ বিএমভি (বেলুন মিট্রাল ভালভুলপ্লাস্টি) করা হয়। এই কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশন এর ক্ষেত্রে ক্যাথিটার ব্যবহার হয় যেখানে সরু হয়ে যাওয়া ভালভের সমস্যা কমানোর জন্য একটি বেলুন ব্যবহার হয়। সৌভাগ্যজনক ভাবে এই অস্ত্রোপচার সফল হয়ে যায়, যার ফলে মা এবং বাচ্চাদের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়।
এই দুটো কেস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ডঃ দিলীপ কুমার বলেন," আমি একটা কথা বেশ জোর দিয়ে বলতে চাই যে আমরা এর আগে বেলুন মিট্রাল ভালভুলোপ্লাস্টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি গর্ভবতী মহিলার উপর। তবে এটা ভারতে প্রথমবার সম্পন্ন হল, হয়তো পৃথিবীতেই। আমরা সফল ভাবে অস্ত্রোপচার করেছি গর্ভবতী মহিলার উপর। অস্ত্রোপচারের পর এখন ঠিক হওয়ার দিকে এগোচ্ছে, গর্ভবতী অবস্থায় ৩৬ সপ্তাহে দুটি সুস্থ যমজ বাচ্চার জন্ম দেন ছত্তিশগড়ে। অন্য দিকে এই ইম্পেলা ট্রিটমেন্ট হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে খুব কম রোগী বিবেচিত হন। খুব কম কেস, প্রায় ১-২% রোগীর ক্ষেত্রে, যাদের পরিস্থিতি খারাপ এবং অ্যাডভান্সড সাপোর্ট ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব যাদের জন্য। এই ট্রিটমেন্ট তাদের জন্য স্বপ্ন, যাদের ক্ষেত্রে সাধারণ চিকিৎসায় সাফল্য খুব কম। পূর্ব ভারতের বাইরে, এই ইম্পেলা ব্যবহার বাড়ছে, দক্ষিণ এবং উত্তর ভারতে ৩-৪ কেস দেখা গিয়েছে। বয়সের হিসেবে দেখা যায় যে ৫৮ থেকে ৫৯ বয়সের ক্ষেত্রে ইম্পেলা সফল হয়। এটা বোঝা যায় যে মধ্য বয়স্ক পপুলেশনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব থাকে যাদের কার্ডিয়াক সমস্যা থাকে। মেডিকাতে আমাদের সেই দক্ষতা রয়েছে এবং আমরা প্রথম হসপিটাল যারা সফলভাবে এই যন্ত্রের ব্যবহার করেছি সেই সব রোগীর ক্ষেত্রে যারা কার্ডিওজেনিক শক এর মুখোমুখি হয়েছে এবং সেরে উঠতে সাহায্য করে। তবে এই ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে ইম্পেলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ শুধুমাত্র যে তা নয়, এর সাথে রয়েছে অনেকটা ফাইন্যান্সিয়াল ইনভেস্টমেন্ট, প্রায় ২৫ লাখ, ৪-৬ ঘণ্টার অপারেশনে। এই ফাইন্যান্সিয়াল দিক থেকে অনেকটাই কমিটমেন্টের প্রয়োজন এই প্রোগ্রাম চালানোর ক্ষেত্রে।"
ইম্পেলা ডিভাইস নিয়ে বলতে গিয়ে প্রফেসর ডঃ রবীন চক্রবর্তী, সিনিয়র কনসালটেন্ট, ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট এবং ইলেকট্রো ফিজিওলজিস্ট, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান - বিভাগীয় প্রধান কার্ডিওলজি সার্ভিসেস, মেডিকা ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিয়াক সায়েন্স (এমআইসিএস) বলেন,"ইম্পেলা ডিভাইস একটি কমপ্যাক্ট ভেন্ট্রিকুলার এসিস্ট ডিভাইস যা একটি ক্যাথিটারের সাথে ব্যবহৃত হয়, যা রক্তকে বাম দিকের নিলয় (ভেন্ট্রিকেল) থেকে আওরটার দিকে। এর ফলে ভেন্ট্রিকুলার হিমো ডাইনামিক সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব হয়, অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়া চলাকালীন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত হয়। কোন কার্ডিয়জেনিক শকের ফলে কারোর হার্ট এ্যাটাক হওয়া থেকে আটকানোর জন্য এটি লাইফ সেভিং ডিভাইস হিসেবে কাজ করে। যাদের হার্ট ভালো কাজ করছে না, রক্ত চাপ কম, এরকম মানুষের উচ্চ রিস্ক সম্পন্ন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি প্রক্রিয়ার সময় হার্টকে সাহায্য করে, যখন অস্ত্রোপচার করা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।
ভারতে এটি এখনও প্রারম্ভিক পর্যায়ে রয়েছে এবং দক্ষ, স্কিল রয়েছে এরকম ইন্টার ভেনশনাল কার্ডিওলজিস্টের খুব প্রয়োজন এর প্রয়োগ বা ব্যবহারের জন্য। এর কম ব্যবহারের অন্যতম কারণ হল এর চড়া দাম এবং ক্রিটিক্যাল ক্লিনিক্যাল কন্ডিশনের উপর এর নির্ভরতার জন্য।"
অয়নাভ দেবগুপ্ত, জয়েন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মেডিকা গ্রুপ অফ হসপিটাল, বলেন," বেশ কয়েক বছর ধরে মেডিকার কার্ডিওলজি টিম অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। এই দুই জটিল কার্ডিয়াক প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে পূর্ব ভারতের হার্টের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে দেবে সার্বিক পরিষেবাকে। দেখা যাচ্ছে যে ইম্পেলা কার্ডিয়াক কেয়ারের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমরা খুবই খুশি যে এই অঞ্চলে সর্ব প্রথম ক্রনিক টোটাল অক্লুষণ (সিটিও) আমরা করতে পেরেছি ইম্পেলার সাহায্যে। এর ফলে আমরা আরো বেশি জীবন বাঁচাতে পারছি যা এর আগে সম্ভব ছিল না। একটি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র হিসেবে ইম্পেলার এই সাহায্য সত্যি অপরিহার্য।
আর উদয়ন লাহিড়ী, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মেডিকা গ্রুপ অফ হসপিটাল, বলেন," মেডিকা সব সময়েই ক্লিনিক্যাল এক্সেলেন্স এর দিকে লক্ষ্য রেখে এসেছে। এই দুটো কেস দেখায় আমরা কিভাবে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে চলেছি বৃহত্তর স্বার্থে। প্রযুক্তির সাথে স্কিল মিলিয়ে আমরা ক্রিটিক্যাল কেস সাফল্যের সাথে দেখে চলেছি। আমাদের গ্রুপের সব হসপিটালের ক্ষেত্রেই একই ভাবে অগ্রসর হয়েছি আমরা। আমরা খুবই খুশি যে দুজন রোগী বর্তমানে ভালো আছেন এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরেছেন।
0 Comments