ওয়েব ডেস্ক; কলকাতা, ৩ ডিসেম্বর : জাতীয় দূষণ প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে প্লাস্টিক দূষণ এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক সম্পর্কিত স্বাস্থ্যসমস্যার জরুরি বিষয়গুলি সামনে আনতে, ইন্ডিয়া ক্লিন এয়ার নেটওয়ার্ক (IndiaCAN) একটি প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করেছিল। বিভিন্ন চিকিৎসা ক্ষেত্রের বিশিষ্ট চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত একটি প্যানেল এই অনুষ্ঠানে পরিবেশগত স্থায়িত্ব এবং জনস্বাস্থ্যের সংযোগের ওপর আলোকপাত করে এবং অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়। চিকিৎসকদের প্যানেল দ্বারা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়, যেখানে নাগরিক, স্কুল, কলেজ, সরকার এবং ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব প্রতিরোধের বিভিন্ন উপায় তুলে ধরা হয়েছে। কলকাতায় উপভোক্তা ও বিক্রেতাদের উপর পরিচালিত প্রাথমিক সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি, একক ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষেধাজ্ঞার স্থায়িত্ব মূল্যায়ন সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়া ক্লিন এয়ার নেটওয়ার্ক।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP)-র মতে, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে, সিঙ্গেল ইউস প্লাস্টিক (SUP) - এর এই ব্যাপকতা গুরুতর পরিবেশগত ও স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি প্লাস্টিক ব্যাগ ল্যান্ডফিলে পচতে প্রায় ১,০০০ বছর সময় নেয়, এবং তারপরও এটি সম্পূর্ণরূপে পচে না। বরং ফটোডিগ্রেডেশন বা আলোক-বিয়োজনের মাধ্যমে এটি মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে এবং পরিবেশ দূষণ করতে থাকে। লো-ডেনসিটি পলিথিন (LDPE) বা পলিইথিলিন টেরেফথ্যালেট (PET) এর মতো প্লাস্টিকের কার্বন ফুটপ্রিন্ট অনেক বেশি; প্রতি কিলোগ্রাম প্লাস্টিক উৎপাদনের ফলে প্রায় ৬ কেজি CO₂ নির্গত হয়। প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইলস (PCB), পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বনস (PAH), ডাইঅক্সিন এবং ফুরান ইত্যাদি বিপজ্জনক রাসায়নিক নির্গত হয়, যা ক্যান্সার এবং হরমোনজনিত সমস্যার মতো গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে। এছাড়াও, এই প্রক্রিয়াগুলি বায়ু দূষণ বৃদ্ধি করে, মাটি ও জল দূষণের মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে তীব্রতর করে।
এই অনুষ্ঠানে ডাক্তাররা মাইক্রোপ্লাস্টিকের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন, যার মধ্যে রয়েছে শ্বাসযন্ত্রের রোগ, পাচনতন্ত্রের সমস্যা, হরমোনজনিত ব্যাঘাত এবং দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগ। মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন সি-ফুড থেকে শুরু করে জল সরবরাহ এমনকি বাতাসেও বিদ্যমান, এই তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি এও বলেন যে দীর্ঘ সময় ধরে এইপ্রকার দূষণের সংস্পর্শে থাকলে তা ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসক - প্রফেসর ডঃ সাধন কুমার ঘোষ, ডিরেক্টর জেনারেল, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সার্কুলার ইকোনমি রিসার্চ সেন্টার, ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, এয়ার অ্যান্ড ওয়াটার (ISWMAW); ডঃ সংযুক্তা দত্ত - কনসালটেন্ট অ্যান্ড হেড , ইমার্জেন্সি মেডিসিন, ফর্টিস হসপিটাল; ডঃ মনিদীপা মণ্ডল - কনসালটেন্ট, রেডিয়েশন অংকোলোজিস্ট, নারায়ণা সুপারস্পেশালিটি হসপিটাল; ডঃ কৌস্তভ চৌধুরী - কনসালটেন্ট পেডিয়াট্রিশিয়ান, অ্যাপোলো মাল্টি-স্পেশালিটি হসপিটাল; এবং ডঃ অরূপ হালদার - কনসালটেন্ট পালমোনোলজিস্ট, সিএমআরআই হসপিটাল প্রমুখ এই প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন।
অজয় মিত্তাল, কো-চেয়ারপারসন, প্রোগ্রামস IndiaCAN বলেন, “আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গুপ্ত অনুপ্রবেশকারী প্লাস্টিক দূষণ এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক শুধুমাত্র পরিবেশ নয়, আমাদের স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। ইন্ডিয়া ক্লিন এয়ার নেটওয়ার্কে আমরা বিশ্বাস করি যে এই সংকট মোকাবিলায় সমষ্টিগত উদ্যোগ, আরও কঠোর নীতি প্রণয়ন এবং সুস্থায়ী জীবনের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার প্রয়োজন।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ২৪% উপভোক্তা এবং ৩০% বিক্রেতা "একক ব্যবহার্য প্লাস্টিক" - এই শব্দটির সাথেই পরিচিত নন, ইংরেজি এবং স্থানীয় ভাষা উভয় ক্ষেত্রেই। মুখ্য অংশীদারদের মধ্যে এই সচেতনতার অভাব প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাসে নীতি প্রয়োগ এবং অনুশীলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
প্রফেসর ডঃ সাধন কুমার ঘোষ - ডিরেক্টর জেনারেল, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সার্কুলার ইকোনমি রিসার্চ সেন্টার, ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, এয়ার অ্যান্ড ওয়াটার (ISWMAW) মন্তব্য করেন, “প্লাস্টিক দূষণ এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিস্তার এমন একটি জরুরি সমস্যা যা অবিলম্বে মনোযোগের দাবি রাখে। এই দূষকগুলি আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে কেবল দূষিতই করে না, বরং সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সুস্থায়ী উন্নয়নের অবনতি ঘটিয়ে সার্কুলার ইকনমির নীতিগুলিকে ব্যাহত করে। এই সমস্যার সমাধানে উদ্ভাবনী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল, নীতি কাঠামো এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন, যা বর্জ্য উৎপাদন হ্রাস এবং বর্জ্যকে মূল্যবান সম্পদে রূপান্তর করতে সহায়ক হবে।”
ইন্ডিয়া ক্লিন এয়ার নেটওয়ার্কের কলকাতায় একক ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষেধাজ্ঞার স্থায়িত্ব মূল্যায়ন প্রতিবেদনটিতে ২৯৯ জন বিক্রেতা এবং ৪৯৩ জন উপভোক্তার উপর সমীক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৭৩% মানুষ "একক ব্যবহার্য প্লাস্টিক" শব্দটির সাথে পরিচিত। ৪৪% উপভোক্তা মাঝে মাঝে SUP (একক ব্যবহার্য প্লাস্টিক) -র ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করেন এবং ৯২.৯% উপভোক্তা পরিবেশবান্ধব ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাওয়াকে সুবিধাজনক মনে করেন। তবে, ৭২% বিক্রেতা জানিয়েছেন যে প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্পগুলি আরও ব্যয়বহুল, যা তাদের ব্যবসার উপর প্রভাব ফেলছে। যদিও SUP-এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে প্রচলিত, কারণ এটি সুবিধাজনক সহজলভ্য এবং ব্যবহারিক, তা স্বত্বেও জনসাধারণের মধ্যে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার জন্য শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ৫১% বিক্রেতাও বিশ্বাস করেন যে প্লাস্টিকের পুনঃব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারের প্রচার নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হবে।
প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য রাখতে গিয়ে, ডাঃ অরূপ হালদার, কনসালটেন্ট পালমোনোলজিস্ট, সিএমআরআই হসপিটাল, বলেন, “আমরা যে বায়ু প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করি তার গুণমান আমাদের ফুসফুসের স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে এবং প্লাস্টিক দূষণ, বিশেষত মাইক্রোপ্লাস্টিক, একটি নতুন এবং উদ্বেগজনক কারণ। এই ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণাগুলি শুধুমাত্র আমাদের জল এবং খাদ্যের মধ্যেই প্রবেশ করছে না, বরং এখন আমাদের শ্বাসবায়ুতেও এর উপস্থিতি সনাক্ত করা যাচ্ছে। প্লাস্টিক দূষণ আর শুধুমাত্র একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়—এটি একটি জনস্বাস্থ্য সংকট। সচেতনতা বৃদ্ধি, নীতি প্রণয়ন এবং সুস্থায়ী বিকল্পের দিকে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে এই অদৃশ্য, কিন্তু ভয়াবহ হুমকির হাত থেকে আমাদের ফুসফুস এবং সমগ্র পৃথিবীকে রক্ষা করা যায়।”
ডাঃ মনিদীপা মণ্ডল, কনসালটেন্ট, রেডিয়েশন অংকোলোজিস্ট, নারায়ণা সুপারস্পেশালিটি হসপিটাল, বলেন, “মাইক্রোপ্লাস্টিক শুধু পরিবেশগত উদ্বেগের বিষয় নয়; এগুলি একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে, বিশেষত ক্যান্সারের ক্ষেত্রে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষাক্ত রাসায়নিক দ্বারা পরিপূর্ণ এই ক্ষুদ্র কণাগুলি বাতাস, জল এবং খাবারের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে এমনকি দেহকোষের ক্ষতি করতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলি, দীর্ঘমেয়াদে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসা এবং ক্যান্সার হওয়ার মধ্যে উদ্বেগজনক সম্পর্ক নির্দেশ করছে, পাশাপাশি হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করার পিছনেও এর ভূমিকা রয়েছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের সাথে কোলোরেক্টাল ক্যান্সার-এর যথাসময়ের পূর্বে সূত্রপাত এবং স্তন ক্যান্সারের অগ্রগতির সম্পর্ক রয়েছে।”
ডঃ কৌস্তভ চৌধুরী - কনসালটেন্ট পেডিয়াট্রিশিয়ান, অ্যাপোলো মাল্টি-স্পেশালিটি হসপিটাল, বলেন, “শিশুরা মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাবের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল। এই ক্ষুদ্র কণাগুলি, তাদের শ্বাসবায়ু, পানীয় জল এবং এমনকি খাদ্যের মধ্যেও থাকে, যা তাদের বিকাশমান শরীরে জমা হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিক শুধুমাত্র পরিবেশ দূষক নয়; এগুলি হরমোনের কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমাতে পারে এবং শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশেও প্রভাব ফেলতে পারে।”
ডঃ সংযুক্তা দত্ত - কনসালটেন্ট অ্যান্ড হেড , ইমার্জেন্সি মেডিসিন, ফর্টিস হসপিটাল, বলেন, “প্লাস্টিক দূষণ, বিশেষ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক, নীরবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এই কণাগুলি, যা ক্ষতিকর রাসায়নিক বহন করে, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে জমা হতে পারে এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন ক্যান্সার এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ হতে পারে। সামাজিক কর্তব্য হিসেবে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি—প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সুস্থায়ী সমাধানের পক্ষে প্রচার চালিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে রক্ষা করা উচিত।”
0 Comments